Poonjo, Zahidur rahim, The Outsider

আলবেয়ার কাম্যু ও বহিরাগতের বয়ান – ২

অবধারিতভাবেই কামু আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রধানতম ব্যক্তিবর্গের একজন হয়ে উঠেছিলেন এবং ফ্রান্সের ইতিহাস ও তাঁর নিজের শতাব্দীর তিনি ছিলেন এক স্বতন্ত্র প্রতিনিধি। – জঁ পল সার্ত্র্‌

ইতালিয়ান লেখিকা এলবা আমইয়া একদা নিজের আত্মজীবনীতে ক্যামু সম্পর্কে বলেন, তিনি তার প্রজন্মে নৈতিক বিবেক ছিলেন। কেন আলবেয়ার ক্যামু এ কালের পাঠকের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ ও প্রভাবক হবার যোগ্য তা স্পষ্ট হবে তার লেখার বিষয় ও আগ্রহ থেকে । ক্যামুর আগ্রহ যেমন বৈচিত্র্য তেমনি তাকে ধারণ করার পাত্রও বৈচিত্র্য। নাটক থেকে শুরু করে ইন্ডি রক কোথায় নেই ক্যামু।

১৯১৩ সালের ৭ নভেম্বর আলবেয়ার ক্যামু জন্মেছিলেন আলজেরিয়ায়। এবং সেখানেই বড় হয়েছেন। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সমতল আর আফ্রিকা অঞ্চলের তপ্ত রৌদ্রে উন্মুক্ত আলজেরিয়া তার লেখায় তাপ ছড়িয়েছে দারুণভাবে। জন্মের পরবর্তী বছরে অর্থাৎ ১৯১৪ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মারা যান তার পিতা। বধির মায়ের অপ্রতুল সহায়তায় ক্যামু বড় হন। আলজেরিয়ায় তার শৈশবের দিনগুলো চরম দরিদ্রতায় কাটে, এমনকি অভাবের কারণে তার এক সময় নানীর কাছে আশ্রয় নেয়। সেখানে তার খুব ভালো কেটেছে তা নয়। তিনি নানীকে পাশবিক ও স্বৈরচারী বলে বর্ণনা করেন পরবর্তীতে। এসব ঘটনার ছাপ পড়ে তার মাঝে। তাই তিনি ছিলেন টোটালিটারিয়ান রেজিমের বিরুদ্ধে একজন যোদ্ধা। বাল্যজীবনের অবাধ জীবন পেয়ে ক্রিড়াবিদ হয়ে ওঠেন ক্যামু।

তিনি স্কুল থেকেই দারুণ ফুটবল খেলতেন। খেলায় তিনি গোল ধরার কাজই করতেন। সেটা নাকি তার জীবনে দারুণভাবে কাজে লেগেছিল। তিনি ফুটবল খেলার কাছে নৈতিকতা ও বাধ্যতা শেখার জন্য ঋণ স্বীকার করেছেন এক লেখায়। কিন্তু কি পরিহাস! বদাভ্যাসের জন্য ফুটবল খেলা বেশি দিন চালিয়ে যেতে পারেননি। খুব খারাপ ধরনের যক্ষা রোগের পরেও তিনি ধুমপান ছাড়েননি। যা তার ফুটবল ক্যারিয়ারের জন্য যম হয়ে দাঁড়ায়। শুনলে মজাই পাবেন তিনি পোষা বিড়ালকে সিগারেট নামে ডাকতেন।

আলজিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের ছাত্র থাকা অবস্থায় যক্ষ্মা রোগে মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরে আসেন।

অধিকাংশ জীবন কাটে পুলিসের কেরানি এবং বিক্রয়কর্মী হিসেবে। অবশেষে সাংবাদিকতায় যোগ দেন। তিনি বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন এবং কমব্যাট নামে একটি আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা চালাতেন।

তিনি একদা আলজার রিপাবলিক্যান নিউজপেপারে রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছিলেন। সাংবাদিকতায় তিনি মুগ্ধ ছিলেন। তিনি একে শ্রেষ্ঠ পেশার মধ্যে একটি মনে করতেন। নাজি দখলকৃত ফ্রান্স স্বাধীন হবার পর তিনি কমব্যাট নামের একটি পত্রিকায় কলাম লিখতেন। আকচুয়ালেস নামে তার রাজনৈতিক সাংবাদিকতা, প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকারের একটি সংগ্রহ বাজারে আছে। এতে অন্তর্ভুক্ত আছে মার্কসবাদ ও অস্তিত্ববাদ নিয়ে তার বৈপ্লবিক চিন্তা। তাকে সচরাচর অস্তিত্ববাদী দার্শনিকদের কাতারে ফেলা হলেও তিনি এই বিষয়ে মজার একটি কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমি অস্তিত্ববাদী নয়। এর সঙ্গে আমাদের নাম যুক্ত আছে দেখে সার্ত্রে আর আমি সবসময় অবাকই হই’।

আলবেয়ার ক্যামু তার ফিকশন ও প্রবন্ধের জন্য বেশি জনপ্রিয়। এছাড়া তিনি ছয়টি নাটক লিখেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত হলো কালিগুলা। এবসার্ডের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে একে দি আউটসাইডার ও দি মিথ অব সিসিফাসের পাশে রাখা হয়।

তিনি তো শুধু উপন্যাস বা প্রবন্ধ সৃজন করেননি, গল্প, নাটক এমনকি কবিতাও লিখেছেন। তিনি উপন্যাসকে নাট্যরূপ দিয়েছেন, অভিনয় করেছেন, এমনকি নাট্যনির্দেশনার সঙ্গেও নিজেকে জড়িয়েছেন। কাজেই নাটকের লোকজন তাঁকে তাঁদের লোক তো মনে করতেই পারেন। ক্যালিগুলা ছাড়াও ফকনার আর দস্তয়েভস্কির উপন্যাসের নাট্যরূপও তিনি দিয়েছেন। নাট্যরূপকেও তিনি রীতিমতো একটা শিল্পের পর্যায়ে দিতে পেরেছিলেন। নাটকের সঙ্গে তাঁর চেতনার রূপান্তরের একটা ইতিহাস হয়তো আছে। একসময় কমিউনিজমের প্রতি তাঁর আস্থা ছিল, তা থেকে ক্রমে সরে আসেন। মৃত্যু, অবিচার, ধ্বংস ইত্যাদি নিয়ে নতুন করে ভাবেন। তিনি লিখেন ভুল আর ক্যালিগুলা নামের নাটক। তিনি ছিলেন নাটকের নবদিগন্ত উন্মোচনকারী। থিয়েটারের পথকে তিনি উজ্জ্বলই করেছেন। তিনি যে-গল্প লিখেছেন সেখানেও জীবনের এক-একটা স্তর অতিক্রম করতে পেরেছেন। জীবন নতুন ধারায় যেন কথা বলেছেন সেখানে।

বিশ শতকের অন্যতম সেরা নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেট ও আর্থার মিলার তার নাটক ও অন্যান্য লেখা থেকে অনুপ্রাণিত ছিলেন। ব্রিটিশ মিউজিক্যাল নাটকে দি আউটসাউডার রেখে গেছে স্থায়ী প্রভাব। স্কটিশ ইন্ডি রক ব্যান্ড ম্যুসাল্টের নাম এসেছে তার বিখ্যাত চরিত্র থেকে। এই ব্যান্ডের গায়ক নিল পেনিকক বলেন, এই দুনিয়ায় যত রাগী তরুণ আছে তাদের সবসময়ই ক্যামু এবং ল’ইস্টানজার (দি আউটসাইডার) কাজে লাগবে।

ক্যামু কবিতাও লিখেছিলেন। তার বিশ বছর বয়সে আলজেরিয়ার স্থানীয় পত্রিকায় ভূমধ্যসাগরের প্রতি ভালোবাসা জানিয়ে দীর্ঘ কবিতা লিখেন। ১৯৩৫ সালে তিনি দর্শনে গ্রাজুয়েট করেন ইউনির্ভাসিটি অব আলজেরিয়াস থেকে। ক্রিশ্চিয়ান মেটাফিজিক্সস এন্ড নিও-প্লেটোনিজম শিরোনামের অভিসন্দর্ভ রচনা তিনি।  কিছুদিন অভিনয়ও করেন তিনি।

মাত্র ছেচল্লিশ বছর বয়সে ১৯৬০ সালের ৪ জানুয়ারি কার এক্সিডেন্টে তিনি মারা যান। এটা নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার মাত্র তিন বছর পরের ঘটনা। কোন এক ইতালিয়ান পত্রিকার মতে এই মৃত্যু ছিলো সোভিয়েত পরিকল্পনার অংশ। কিন্তু ক্যামু’র কথা ধরলে এটা একটা আকস্মিক ঘটনা মাত্র। দুনিয়ার অনেক অর্থহীন ঘটনার একটি।


Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।