নিঃসঙ্গতার আ‌দ্যোপান্ত (ব্রেনে ব্রাউন থেকে অনুবাদ)

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানী জন কাচিওপা নিঃসঙ্গতা নিয়ে বিশ বছর গবেষণা করেছেন। তিনি নিঃসঙ্গতাকে এভাবে ধরতে চান, ‘অনুভব করা যায় এমন এক সামাজিক বিচ্ছিন্নতা’। আমরা যখন সংযোগ খুঁজে পাই না, তখন আমরা নিঃসঙ্গতা অনুভব করি। হতে পারে আমাদের পছন্দের কোনো এক দল আমাদের কোণঠাসা ক’রে সরিয়ে দিয়েছে। হয়ত আমাদের আপন বলতে কেউ নেই। নিঃসঙ্গতার মর্মমূলে আছে অর্থপূর্ণ সামাজিক আদানপ্রদানের অনুপস্থিতি। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, বন্ধুতা, পারিবারিক মিলন, কর্মক্ষেত্রের সংযোগের অভাব।

নিঃসঙ্গতা আর একা থাকা কিন্তু ভারি আলাদা জিনিস। একা থাকা নিরাময়ের জন্য খুব ভালো ওষুধ হতে পারে। আমি নিজে একজন অন্তর্মুখী মানুষ হিসেবে সেই একা একা থাকার মুহূর্ত উপভোগ করি। আমার বরং নিঃসঙ্গতার বোধ তখনই বেশি কাজ করে যখন আমি লোকজনের মধ্যে থাকি। আমরা আমাদের পরিবারে সেই অনুভূতির নাম দিয়েছি, “বুক খাঁ খাঁ করা”।

বলে বোঝাতে পারব না কতোবার স্টিভকে ফোন করে বলেছি, “আমার বুকটা খাঁ খাঁ করছে।” এর নিরাময় সাধারণত ওর সঙ্গে অথবা সন্তানদের সঙ্গে একটু কথা বলে নেওয়া। হয়ত শুনতে অদ্ভুত লাগতে পারে, কিন্তু এমন মুহূর্তে স্টিভ আমায় কখনো কখনো বলে, “কিছুক্ষণ একলা থেকে দেখো।” এতে নিরাময় হয়। মানুষের মধ্যে থেকে নিঃসঙ্গ হবার মতো নিঃসঙ্গতা আর নেই।

আমরা এই ‘বুক খাঁ খাঁ করা’ কথাটা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করি। কোনো খাবার দোকানে ব’সে আমার সন্তানেরা হয়তো বলে উঠল, “এ জায়গাটা ভালো লাগছে না। বুক খাঁ খাঁ করছে।” অথবা, “আমার বন্ধু কি আজ আমাদের বাসায় রাত কাটাতে পারে? ওর বাড়িতে ওর বুকটা খাঁ খাঁ করছে।”

আমার পরিবারের চার জন যখন এক সঙ্গে বোঝার চেষ্টা করি, এই ‘বুক খাঁ খাঁ করা” বলতে আমরা প্রত্যেকে কী বুঝি, দেখা যায়, যে জায়গায় প্রাণবন্ত সংযোগ নেই, সেই জায়গায় আমাদের বুক “খাঁ খাঁ করে”। তাই আমার বিশ্বাস, শুধু মানুষ নয়, স্থান বিশেষও সেই “খাঁ খাঁ করা” অনুভূতির জন্ম দিতে পারে। হয়তো সে এমন স্থান, যেখানে সংযোগের অভাব রয়েছে। অনেক সময় আমরা যাদের পুঁছি এমন মানুষের সঙ্গে সংযোগের অভাব সে স্থানকে আমাদের কাছে নিঃসঙ্গ করে তোলে।

স্বাতন্ত্র্য থেকে ততোটা শক্তি গ্রহণ করি না, যতোটা করি এক সঙ্গে ব’সে ছক কেটে, কথা ব’লে, কাজ ক’রে। আমাদের স্নায়ু, আমাদের হরমোন, আমাদের বংশানু, আমাদের একলা চলার চেয়ে বেশি মিলেঝুলে সামাজিক জাল বুনে কাজ করার পেছনে সমর্থন দেয়। কাচিওপো বলেন, “একটি সামাজিক প্রাণীর সাবালক হওয়া মানে এই নয়, যে এবার থেকে একলা চলতে হবে, অথবা স্বয়ংক্রিয় হতে হবে। বরং এমন হওয়া, যার ওপর সকলে নির্ভর করতে পারে। আমরা হয়ত জানি, হয়ত বা জানি না, কিন্তু আমাদের মগজ আর জৈব গঠন আমাদের এমনটাই ক’রে তুলতে চেষ্টা করছে।” আলবৎ আমরা সামাজিক জীব। মিশুক প্রাণী। সেই জন্য সংযোগ এমন জরুরি। সেই জন্য আমরা দুনিয়ায় আপন হতে চাই।

কাচিওপো জানান আমাদের দেহঘড়ি কেমন ক’রে কাজ করে। আমরা যখন ভালো মতো বেঁচেবর্তে নেই, তখন আমাদের মগজ নানান ভাবে আমাদের সংকেত পাঠাতে থাকে। ক্ষুধা আমাদের জানায় আমাদের রক্তে চিনি কম, এবার খেতে হবে। তৃষ্ণা আমাদের জানায় জল পান করতে হবে, নইলে শুকিয়ে যেতে পারি। ব্যথা আমাদের জানায় দেহের কোনো কলা, কোনও কোষ আহত হয়েছে। এবং নিঃসঙ্গতা আমাদের জানায় — আমাদের সামাজিক সংযোগের প্রয়োজন। খাদ্য পানীয় জলের মতোই তা একান্ত প্রয়োজনীয়। তিনি বলেন, “আমাদের ক্ষুধা পেয়েছে এ কথা অস্বীকার করা যেমন অর্থহীন, আমরা নিঃসঙ্গতায় ভুগছি এ কথা অস্বীকার করাও ততোটা অর্থহীন।”

…আমরা নিঃসঙ্গতাকে অস্বীকার করি। আমি যেহেতু লজ্জা নিয়ে আগে কাজ করেছি, আমি এই চৌহদ্দি চিনি। নিঃসঙ্গতাবোধ নিয়ে আমাদের কিন্তু লজ্জা (shame) কাজ করে। যেন নিঃসঙ্গতাবোধ এক ধরণের মনোবিকার। এমনকী এই নিঃসঙ্গতা যখন শোক, মৃত্যু,বিচ্ছেদ বা বুকভাঙা অভিজ্ঞতা থেকে আসে,তখনো। কাচিওপো জানান, নিঃসঙ্গতা নিয়ে আমরা দীর্ঘ দিন যাবৎ যেভাবে কথা বলেছি তার জন্যই এই হাল। আমরা নিঃসঙ্গতার বর্ণনা করি এ ভাবে: “কুরে কুরে খাওয়া এক দুরারোগ্য অসুখ যার কোনো নিরাময় নেই।” নিঃসঙ্গতাকে লাজুক হওয়া, অসামাজিক হওয়া, একলষেড়ে হওয়ার সঙ্গে এক ক’রে দেখা হয়। ‘অসামাজিক’ শব্দটা আমরা নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করি।


Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।